Thursday, November 24, 2011

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকারের সংক্ষিপ্ত জীবনী



মোনায়েম সরকার ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার ফতেহাবাদ গ্রামে এক সম্্‌ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেনরাজনীতিতে হাতে খড়ি স্ড়্গুল জীবন থেকেস্ড়্গুল ক্যাপটেন হিসেবে তিনি তখনকার ছাত্র আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে এম·এসসি· ডিগ্রি লাভ করার পর বাম রাজনীতির টানেই তিনি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীর জীবন বেছে নেনতিনি ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেনমুক্তিযুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন
বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর মোনায়েম সরকার বাংলাদেশে স্বাধীনতার ধারা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনমত গড়ে তোলেন যুক্তরাজ্য ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেপঁচাত্তর পরবর্তী প্রায় ৪ বছর প্রবাস জীবনে তিনি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পি·এন· হাকসার, ভূপেন গুপ্ত, রমেশ চন্দ্র, রাজেশ্বর রাও, ভি·টি· রনধিকে, অধ্যাপক শান্তিময় রায়, গণেশ ঘোষ, মন্মথ নাথ গুপ্ত প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেনশওকত ওসমান রচিত উত্তর পূর্ব মুজিবনগর গ্রন্থে মোনায়েম সরকারের বিশেষ এক পরিচিতি লক্ষণীয়ডায়েরির ১৭ জানুয়ারি ১৯৭৯ তারিখে  লেখা হয়ঃ দেশাত্মবোধের সঙ্গে জীবন-এষণা এমনভাবেই মিলেছে যে বঙ্গবন্ধুর মৃতুøর পর আর দেশে থাকতে পারেনিএখানে সে যেন সব রাজনৈতিক রিফিউজিদের অভিভাবক হয়ে বসেছিলঅভাবগ্রস্তদের জন্যে টাকা-পয়সা যোগাড় করা থেকে রাজনৈতিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে কত ভাবে না নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিল···
ওই সময়ে মোনায়েম সরকারের উদ্যোগে বিভিন্ন গোপন লিফলেট, বুকলেট প্রকাশিত হয়তিনি বিভিন্ন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখেনতখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় বজ্রকণ্ঠ, লন্ডন থেকে-  প্রতিরোধ, বাংলার ডাক, সোনার বাংলা, ঝঁহ জরংব প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশে বিদেশে জনমত সৃষ্টি করেন১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেনবঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেনস্বৈরাচারী সামরিক সরকার জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য ১০-দল, ১৫-দলীয় জোট গঠনে এবং অন্দোলনের  বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেনতিন জোটের ঐক্য গঠনে এবং রূপরেখা প্রণয়নেও বিশেষ অবদান রাখেননিভৃতচারী মোনায়েম সরকার সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছেনদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্ড়্গৃতিক আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও সংস্ড়্গৃতি ও সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁর পদচারণা অবারিততিনি উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাতিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেনতাঁর লেখায় সমসাময়িক চলমান রাজনীতির বিষয়াদি প্রাধান্য পায়
তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলি হলোঃ বাংলাদেশে বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের উত্থান অনিবার্য (১৯৮৭), রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি (১৯৮২), বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র বিকাশে ঐক্য অপরিহার্য (১৯৯১), ইতিহাসের আলোকে বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ ও বঙ্গবন্ধু (১৯৯২), জাতীয় বিকাশের মূলস্রোত বনাম তৃতীয় ধারা (১৯৯২), গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান বামপন্থীদের করণীয় (১৯৯২), বামপন্থীদের সঙ্কট ও বাংলাদেশের রাজনীতি (১৯৯৩), ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু (১৯৯৪), মৃতুøঞ্জয়ী মুজিব (১৯৯৫), বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (১৯৯৬), জাতীয় চার নেতা স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৬), বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস (যৌথভাবে) (১৯৯৭), স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৭), শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ (১৯৯৮), বাঙালি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু (২০০০), বহতা নদীর মত আওয়ামী লীগ (২০০০), বাঙালির কণ্ঠ (২০০১), একজন রাজনৈতিক কর্মীর প্রতিচ্ছবি (২০০৩), যুক্তফ্রণ্ট থেকে মহাজোট (২০০৭), জাগো বাঙালি কোন্‌ঠে সবায় (২০০৭), স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রণ্টঃ চুয়ান্নর অভিজ্ঞতা (৫৪-র নির্বাচনের অপ্রকাশিত দলিল), জেগে ওঠার সময় এখনই (২০০৭), বাংলা একাডেমী কর্তৃক মোনায়েম সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর জীবনী গ্রন্থ (দুই খণ্ডে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জীবন ও রাজনীতি (২০০৮), রাজনীতির চালচিত্র (২০০৮), বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ণের সমস্যা ও সম্্‌ভাবনা (২০০৯), Left Democratic Humane World Order (2009) (২০০৯), মোনায়েম সরকারের নির্বাচিত রাজনৈতিক রচনা (২০০৯), সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি (২০১০), বাঙালির ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ (২০১০), United Nations and Global Crises (২০১০), বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও শেখ হাসিনা (২০১১), বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির সংকট ও সম্্‌ভাবনা (২০১১) ইত্যাদি
সাপ্তাহিক যুগবাণী, নতুন বাংলা, দেশবন্ধু ও মৃদুভাষণ প্রকাশনা-সম্পাদনার কাজে চার দশক শ্রম ও মেধা দিয়ে অবদান রাখেনবর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর মহাপরিচালক

Monday, November 29, 2010

In Memory Of Gaus Khan


স্মৃতির অ্যালবামে ঝকঝকে গাউছ খান
মোনায়েম সরকার
আওয়ামী লীগ, যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সভাপতি গাউছ খানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শেখ মুজিব রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে লন্ডনে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে জেনে ভীষণ ভালো লাগছে। মহাকালের ধারায় একটা জীবনের মূল্য তেমন কিছুই নয়; কিন্তু একটা বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন মানুষ যে কতো বিশাল ভাবমূর্তি ধারণ করতে পারে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর গাউছ খানের ভূমিকা তৎপরতার কথা স্মরণ হলে সহজেই তার উত্তর পাওয়া যায়।
চার যুগ আগের কথা, অথচ স্মৃতির অ্যালবামটা কতো ঝকঝকে। ছবিগুলিও কথা বলছে অবিকলভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ৭৫-এর ১৪ অক্টোবর আমি কোলকাতায় চলে যাই। ওই সময়টায় মোশতাক সরকার এবং কয়েকদিন পর প্রতিষ্ঠিত জিয়ার সামরিক শাসনের চরম নিবর্তনমূলক আক্রমণের মুখে আওয়ামী লীগ তথা সেক্যুলার ধারার রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছিলো না। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত, শীর্ষ নেতাদের অনেকেই জেলে, কর্মীরা বিচ্ছিন্ন, সর্বোপরি জনগণ সামরিক রক্তচক্ষুর ভয়ে ভীত। ৭৫-এর bf¤^i জেলখানায় জাতীয় চার শীর্ষ নেতার হত্যাকাণ্ড এবং bf¤^i জেনারেল জিয়ার একক ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি এক মহাসঙ্কটে নিপতিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সেক্যুলার ধারার রাজনীতিকে ধ্বংস করার এক মহাআয়োজনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জিয়া। এমন একটি দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যাতে সেক্যুলার ধারায় ফিরতে পারে, পৃথিবীর দুটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বড় শহর লন্ডন এবং কোলকাতায় সেই লক্ষ্যে অনেক মহৎপ্রাণ ব্যক্তি কাজ করে যাচ্ছিলেন। কোলকাতায় যাদের আমি ধরনের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখেছি তাদের মধ্যে রয়েছেন রনেশ দাশ গুপ্ত, শওকত ওসমান, জাওয়াদুল করিম, সঞ্জীব দত্ত, মাহফুজুল বারী, নজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের আনোয়ার চৌধুরী, রওশন আলী, এখলাসউদ্দিন, শামসুদ্দিন মোল্লা প্রমুখ।
কোলকাতায় বসেই আমরা খবর পেয়েছিলাম, লন্ডনেও জিয়ার সামরিক শাসনবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন অনেকে। আমি ন্যাপের যুক্তরাজ্য শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফকে চিঠি লিখি লন্ডনে। তার মাধ্যমেই গাউছ খান, গাফ্‌ফার চৌধুরী, রুহুল কুদ্দুস এবং এম আর আক্তার মুকুলসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে আমার। রউফ সাহেব ব্যারিস্টার সাঈদুর রহমান . নুরুল আলমকে নিয়ে প্রতিরোধ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। পরবর্তী সময়ে গাফ্‌ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলার ডাক, এম আর আখতার মুকুলের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায়) এবং আবদুল মতিনের সম্পাদনায় মাসিক সানরাইজ পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। লন্ডন থেকে এসব পত্রিকা কোলকাতায় আমার কাছে আসতো, আমি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ইত্যাদি রাজ্যের বর্ডার দিয়ে সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতাম। একইসঙ্গে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বজ্রকণ্ঠও পাঠানো হতো। এসব পত্রিকা এমনকি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে যেতো।
গাউছ খান তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি। বয়সে প্রবীণ, কিন্তু মনের দিক থেকে বেশ সজীব। বলে নেয়া ভালো, লন্ডন আওয়ামী লীগে তখন নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধ চলছিলো। কারো কারো মধ্যে সুবিধাবাদও কাজ করছিলো। দলে ইনফিলট্রেটর ছিল অনেক, যারা দলকে প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ঠেলে দিতে তৎপর ছিলেন। গাউছ খান ওই বয়সেও এসব প্রতিকূলতার মধ্যে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টাই করেননি শুধু, দলীয় কর্মকাণ্ডের গতি পরিধি বাড়ানোয় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বার্ধ্যকের শরীর নিয়ে কম্পিত হস্তে আমাকে একাধিক চিঠি দিয়েছিলেন। এসব চিঠি পড়ে আমার বুঝতে বাকি থাকে না, দলাদলিসহ ভয়ানক সব প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে কাজ করে যেতে হয়েছিল। গাউছ খান শুধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতাতেই লিপ্ত ছিলেন না, তিনি ইংল্যান্ডে অবস্থানরত বিশিষ্ট বাঙালিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদেরকেও আন্দোলনে শরিক করানোর চেষ্টা করেছিলেন। অক্সফোর্ডে  . কামাল হোসেন, . মুশারফ হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রমুখদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন প্রথম দিকে বেশ উৎসাহ দেখালেও পরবর্তী সময়ে তারা সেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। 
একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনে একটা শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন গাউছ খান। এই শোকসভায় তখনকার আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আনোয়ার চৌধুরী, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম ছাত্রনেতা ইসমত কাদির গামাসহ আমারও যোগ দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য ছিলাম বলে দলের অনুমতি নিতে গেলে খোকা রায় বললেন, তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমার যাওয়া হলো না, ভ্যালিড পাসপোর্ট না থাকার কারণে আনোয়ার চৌধুরী গামাও যেতে পারলেন না। মাযহারুল ইসলাম একাই গেলেন। আমরা তখন বাংলাদেশ : ভিকটিম অফ ইম্পেরিয়ালিস্ট কন্সপিরোসি নামে একটা বুকলেট বের করেছিলাম। ওই বুকলেটে ৭৫ ট্রাজিডিতে যারা যারা মারা গেছেন এবং ওই সময়ে যারা যারা জেলে ছিলেন, তাদের একটা তালিকাসহ সমসাময়িক রাজনীতির একটা সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছিলো। স্থপতি মাযহারুল ইসলাম কয়েকশ বুকলেট সঙ্গে করে নিয়ে যান লন্ডনে। একই বুকলেট বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলী আকসাদ নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে।
যাহোক, লন্ডনের ওই শোকসভায় খন্দকার মোশতাকের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ওয়ালী আশরাফের নেতৃত্বে একটি কোটারি প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের সময় তারা তাতে অংশ না নিয়ে হট্টগোল পাকাতে থাকে। গাউছ খান তার বার্ধক্যের দুর্বল শরীর নিয়েও এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সেই কুচক্রীমহল হালে পানি না পেয়ে পিছু হটে।
আমার কাছে লেখা গাউছ খানের একটি দীর্ঘ চিঠি আমি কয়েকদিন আগে গাফ্‌ফার চৌধুরীকে দিয়েছি। উনি সেটা ছাপানোর ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। এই চিঠিটিতে তৎকালীন লন্ডন রাজনীতির নানা চিত্র ফুটে উঠেছে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তথা ইনফিলট্রেটররা কিভাবে পাল্টা কমিটি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী দুর্দিনে কারা কিভাবে রাজনীতির হাল ধরেছিলেন, কারাই বা কিভাবে সুবিধাবাদ দ্বারা চালিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন- সবই জানা যায় সেই চিঠির মাধ্যমে। আমি নিজে কোলকাতা থেকে চিঠি নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করে লন্ডন আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব-বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছিলাম। সেসব কথা না- বা বললাম।
গাউছ খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এক অকৃত্রিম ভক্ত। ৭৫-পরবর্তী কিছু সময় লন্ডনে যখন বাকশাল না আওয়ামী লীগ- ধরনের একটি মতাদর্শগত কূটতর্ক চালিয়েছিলেন সুবিধাবাদী একটি শ্রেণী, গাউছ খান তখন সেই বিতর্কে না জড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শ অনুসারী হিসেবে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চেষ্টায় তিনি সফলও হয়েছেন, যার কারণে আওয়ামী লীগ না বাকশাল কূটতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে লন্ডন আওয়ামী লীগ এখন ঐক্যবদ্ধ। ১৯৮০ সালের ১০ মে এই মহৎপ্রাণ মানুষটি ছেড়ে গেছেন পৃথিবী। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
পুনশ্চ :
বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে কোলকাতায় আমরা সামরিক শাসন বিরোধী যে ব্যাপক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত  থেকে মুক্তিযুদ্ধ ¯^vaxbZv ধারার সেক্যুলার রাজনীতিকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন করছিলাম, তার পুরো বর্ণনা দেয়া এই ¯^í পরিসরে সম্ভব নয়। তবে কয়েকদিন আগে কালের কণ্ঠের সাংবাদিক শরীফা বুলবুল আমার পুরনো নথিপত্র ঘাটতে গিয়ে তিনশরও অধিক চিঠি আবিষ্কার করেন। এই চিঠিগুলি সাড়ে তিন বছরের নির্বাসিত জীবনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাকে যারা লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন- গাউছ খান, আবদুর রউফ, গাফ্‌ফার চৌধুরী, রুহুল কুদ্দুস, . মুশারফ, কাদের সিদ্দিকী, সুইডেনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত কে. এম. কাদের, মস্কো থেকে মোহাম্মদ, দিল্লী থেকে .এল. খতিব, লন্ডন থেকে মাযহারুল ইসলাম প্রমুখ। শীঘ্রই এই চিঠিগুলি সংকলিত করে একটি এবং সাড়ে তিন বছরে কোলকাতা লন্ডন থেকে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো দিয়ে আরেকটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন রানা নিশাত।
লন্ডন কোলকাতা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়, সেগুলোর প্রকাশকাল, সম্পাদক এবং স্থায়িত্ব তুলে ধরা হলো :    
. সাপ্তাহিক প্রতিরোধ : লন্ডন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় wW‡m¤^i ১৯৭৫। এটি ছিল একটি এক পৃষ্ঠার কাগজ এবং ২১ এপ্রিল ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তা প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেন আবদুর রউফ, ডা. নূরুল আলম, ব্যারিস্টার সাইদুর রহমান প্রমুখ। গাউছ খান এই পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।
. সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ : ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ২৯ জুন ১৯৭৬। পৃষ্ঠার কাগজ। মোনায়েম সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং নজিবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ২৯ জুন ১৯৭৭ পর্যন্ত চলে।
. সাপ্তাহিক বাংলার ডাক : লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬। পৃষ্ঠার কাগজ। সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।
. সোনার বাংলা (বাংলা) : ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। পাতার কাগজ। সম্পাদক ছিলেন এম আর আখতার মুকুল।
. সোনার বাংলা (ইংরেজি) : ১ম সংখ্যা বের হয় ২৪ অক্টোবর ১৯৭৬। প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। পাতার কাগজ। সম্পাদক এম.আর আখতার মুকুল। ১৭ এপ্রিল ১৯৭৭ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়।
. Sun Rise : এই মাসিক ইংরেজি পত্রিকা আবদুল মতিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত এর প্রকাশনা অব্যাহত থাকে।